আর তারপর?
-তার আর কোনো পর নেই। ওখানেই শেষ।
ভীষণরকম লড়াই চালিয়ে যাওয়ার পরে যখন আজকাল একটু জিরোতে যায় তখনই মৃদুলার নানান মানসিক যন্ত্রণা, চিন্তা ছেঁকে ধরে। যথোপযুক্ত আরাম আর নেওয়া হয়না। প্যাচপ্যাচে গরমে ঘেমে নেয়ে এসে গা ধুয়ে বসার সময়েই তার মনের মাঝে একটাই কথা ঘুরে ফিরে আসে। "বয়স হচ্ছে। কিছু করতে হবে। কিছু করতেই হবে। আর কতদিন বুড়ো বাপের ওপর বোঝা হয়ে থাকবো?" আসলে কথাটা ওর নয়। ওর মনের মাঝে কেউ বা কারা রোপন করেছে।
শুরুটা এমন কিন্তু ছিলো না। বেশ মধুর ছিলো। সবকিছুই ঘেঁটে দিলো বর্তমান পরিস্থিতি। অভূতপূর্ব এক ক্ষতির পরে মন, শরীর সব গোছাতে ব্যস্ত থাকায় আজকাল আর শিশির মাখা চিকন ঘাস, কুয়াশাকে দেখতে পায়না। বা বলা চলে দেখতে চায়না। কঠোর বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এসব আর মানায়না।
এসবই হাবিজাবি লেখা ছিলো ওর ডায়েরিতে। কিন্তু দুঃখের সাথে বলার সেই ডায়েরিটাও আজ নেই। পাতা আছে। কিন্তু সব খালি। আজকাল নাকি ওর শূন্যতার মধ্যের লেখা, কথাকে বেশি আঁকড়ে ধরছে।
আসলে এইটা একটা ব্যাধি। আর তার শিকারও হয় অনেকেই। নিজেকে একদম ছোট্ট চিলেকোঠার ঘরে বন্দী রেখেছে। ভেঙে যাওয়ার পরে উঠতে গেলে নিজের সবকিছু হারিয়ে এই ঘরটাই আজ তাকে সাহায্য করেছে। এমনই নাকি ও বলতো। আসলে বলা হয়নি মৃদুলার মৃত্যুর পরে খোলা ডায়রিটা দেখে নাকি সবাই এসবই বলছে।
শেষ কয়েকটা পাতায় কিছু লেখা ছিলো। "জন্মদিনের দিন রাত বারোটায় বাবার দেওয়া তিনশ টাকাটা আজ ল্যামিনেশন করানোর পরে একটা শান্তি লাগছে। বাবার ছোঁয়া আছে। আর মা আর বাবার ছবিটাও ল্যামিনেশন করিয়ে মনে হচ্ছে এইবার ডায়েরি লেখার পর্ব শেষ হলো। আর হারাবে না এগুলো।"
কাকিমা মানে মৃদুলার মা, খুব কেঁদে নাকি বলেছিলো মৃদুলা কোনোদিন গান শেখেনি। অথচ কদিন ধরেই গান গুনগুন করছিলো মনে। যে মেয়ে কোনোদিন রবিঠাকুরের কোনো গানকেই গুনগুন করেনি সে যখন গুনগুন করতো কেমন যেন লাগতো। বড্ডো শক্ত ছিলো মেয়েটা আমার।
"অমল ধবল প্রাণে লেগেছে , মন্দ মধুর হাওয়া..." এখনও চিলেকোঠায় গেলে কাকিমা মনেমনে এই গানটাই গুনগুন করে। এতে নাকি মৃদুলার ছোঁয়াকে জাগিয়ে রাখতে পারে।
ছোটো টাইমফুলের গাছের পাশে জমে থাকা শ্যাওলার শিশির আজ মৃদুলার কথা ভেবে হাসে। ধীরে ধীরে তারা ওদের মনে জায়গা করছে। শ্যাওলা ধরছে ওদের শরীরে, মনে আর চোখে। হয়তো কোনো একদিন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে ওরা। ওদিকে কাকিমা গুনগুন করে:
"অমল ধবল প্রাণে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া, দেখি নাই কভু দেখি নাই, এমন তরণী বাওয়া..."

বাহ দারুন
উত্তরমুছুন