সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

স্পর্শ- শ্রীদত্তা সেন


 

আর তারপর?

-তার আর কোনো পর নেই। ওখানেই শেষ। 


ভীষণরকম লড়াই চালিয়ে যাওয়ার পরে যখন আজকাল একটু জিরোতে যায় তখনই মৃদুলার নানান মানসিক যন্ত্রণা, চিন্তা ছেঁকে ধরে। যথোপযুক্ত আরাম আর নেওয়া হয়না। প্যাচপ্যাচে গরমে ঘেমে নেয়ে এসে গা ধুয়ে বসার সময়েই তার মনের মাঝে একটাই কথা ঘুরে ফিরে আসে। "বয়স হচ্ছে। কিছু করতে হবে। কিছু করতেই হবে। আর কতদিন বুড়ো বাপের ওপর বোঝা হয়ে থাকবো?" আসলে কথাটা ওর নয়। ওর মনের মাঝে কেউ বা কারা রোপন করেছে। 


শুরুটা এমন কিন্তু ছিলো না। বেশ মধুর ছিলো। সবকিছুই ঘেঁটে দিলো বর্তমান পরিস্থিতি। অভূতপূর্ব এক ক্ষতির পরে মন, শরীর সব গোছাতে ব্যস্ত থাকায় আজকাল আর শিশির মাখা চিকন ঘাস, কুয়াশাকে দেখতে পায়না। বা বলা চলে দেখতে চায়না। কঠোর বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এসব আর মানায়না। 


এসবই হাবিজাবি লেখা ছিলো ওর ডায়েরিতে। কিন্তু দুঃখের সাথে বলার সেই ডায়েরিটাও আজ নেই। পাতা আছে। কিন্তু সব খালি। আজকাল নাকি ওর শূন্যতার মধ্যের লেখা, কথাকে বেশি আঁকড়ে ধরছে। 


আসলে এইটা একটা ব্যাধি। আর তার শিকারও হয় অনেকেই। নিজেকে একদম ছোট্ট চিলেকোঠার ঘরে বন্দী রেখেছে। ভেঙে যাওয়ার পরে উঠতে গেলে নিজের সবকিছু হারিয়ে এই ঘরটাই আজ তাকে সাহায্য করেছে। এমনই নাকি ও বলতো। আসলে বলা হয়নি মৃদুলার মৃত্যুর পরে খোলা ডায়রিটা দেখে নাকি সবাই এসবই বলছে। 


শেষ কয়েকটা পাতায় কিছু লেখা ছিলো। "জন্মদিনের দিন রাত বারোটায় বাবার দেওয়া তিনশ টাকাটা আজ ল্যামিনেশন করানোর পরে একটা শান্তি লাগছে। বাবার ছোঁয়া আছে। আর মা আর বাবার ছবিটাও ল্যামিনেশন করিয়ে মনে হচ্ছে এইবার ডায়েরি লেখার পর্ব শেষ হলো। আর হারাবে না এগুলো।" 


কাকিমা মানে মৃদুলার মা, খুব কেঁদে নাকি বলেছিলো মৃদুলা কোনোদিন গান শেখেনি। অথচ কদিন ধরেই গান গুনগুন করছিলো মনে। যে মেয়ে কোনোদিন রবিঠাকুরের কোনো গানকেই গুনগুন করেনি সে যখন গুনগুন করতো কেমন যেন লাগতো। বড্ডো শক্ত ছিলো মেয়েটা আমার। 


 "অমল ধবল প্রাণে লেগেছে , মন্দ মধুর হাওয়া..." এখনও চিলেকোঠায় গেলে কাকিমা মনেমনে এই গানটাই গুনগুন করে। এতে নাকি মৃদুলার ছোঁয়াকে জাগিয়ে রাখতে পারে। 


ছোটো টাইমফুলের গাছের পাশে জমে থাকা শ্যাওলার শিশির আজ মৃদুলার কথা ভেবে হাসে। ধীরে ধীরে তারা ওদের মনে জায়গা করছে। শ্যাওলা ধরছে ওদের শরীরে, মনে আর চোখে। হয়তো কোনো একদিন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে ওরা। ওদিকে কাকিমা গুনগুন করে: 


"অমল ধবল প্রাণে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া, দেখি নাই কভু দেখি নাই, এমন তরণী বাওয়া..."

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ঝড়ের আড়ালে- দোলা সাহা

  অসহায় স্তব্ধতায় বুক দুরু দুরু; ক্ষনিক আশা যাহা ছিল মনে, ভাঙিল তা প্রবল করাঘাতে। বেদনার গ্লানি, আর শোকাতুর মন বাধিল ক্ষনিক আশা একটু স্নেহের পরশ জরাহীন ভারতবর্ষ মুক্ত করো সবে হারিয়ে যেতে দেবনা আমরা গভীর অন্ধকারে শত শত ক্ষত ভরিয়ে তুলব- গভীর মমতায় ভরা স্নেহের প্রলেপে।

অন্য পুজো - পিনাক

  ১ অনেকদিন ধরেই ছেলেটা বায়না ধরেছে এবার পূজোয় একটা নতুন জিন্সের প্যান্টের জন্য। বছরদুয়েক আগে ওর বাবা অন্ধ্রে রাজমিস্ত্রীর কাজ করতে গিয়েছিলো, তারপর থেকে আর ফেরেনি। এখনো পর্যন্ত তার কোনো খোঁজখবরও পাইনি সে।পাঁচবাড়ি দুইবেলা কাজ করে কোনোমতে সংসারটা টেনেটুনে চলে যায় আর মিডডে মিলের দয়ায় ছেলের একবেলা পেটটা কোনোরকমে ভরে যায় রোজ। অনেক ইতস্তত করে আজ বড়বাড়ির বৌ এর কাছে পাঁচশ টাকা চেয়েই বসেছিল ফুলমনি ছেলের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। অনেকদিনের বিশ্বস্ত লোক, দু'বছরে একদিনও কামাই করেনি:বড়বাড়ির বৌ তাই টাকার কথাতে একবারের বেশী দুবার ভাবেনি।  আজ বিকেলে মনটা বেশ খুশি ছিল ফুলমনির। টুসিদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাড়ি না ফিরে সোজা চলে গিয়েছিল বড়রাস্তার ধারে কাঁচের দরজা দেওয়া জামাকাপড়ের দোকানটার দিকে। রাস্তায় গাড়ি বেশী ছিলো না তখন; দোনোমোনো করে রাস্তাটা পেরোতে গিয়েছিল সে। বকুলতলার দিক থেকে বিকট শব্দ করে হঠাৎ একটা গাড়ি চলে আসে দানবের মতো! তারপর... মায়ের ডাকে ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে যায় পল্লবের! ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে সে বিছানায়... ২ ৩৪ নং জাতীয় সড়ক ধরে শ্যমলকে বাইক চালিয়ে রোজই ফিরতে হয় অফিস থেকে। আজ অফিস থেকে বেড়িয়ে অফিসের ...

পচন- মনোজ কুমার সরকার

  আজ যে কাহিনীর অবতারণা করতে চলেছি পাঠকের কাছে তা নিছক একটি গল্প হলেও আসলে আমার জীবনেই এই বিচিত্র ঘটনাটি ঘটেছিল। অন্তত সেদিন একবিংশ শতাব্দীর যুক্তিবাদী শিক্ষিত মানুষ হওয়া সত্বেও আমি এই ঘটনার জটিল রহস্যের কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি। সেই বিচিত্র ঘটনার দর্শকের ভূমিকা নেওয়া ছাড়া সেদিন আমার আর কিছুই করার ছিল না। বছর দশেক আগের কথা। সেবার গ্রীষ্মের ছুটিতে গেলাম মামার বাড়ি বেড়াতে ।মা, বাবা, ভাই ও আমি অর্থাৎ সপরিবারে ।আমার মামাবাড়ী রানাঘাটে কাপাস ক্যাম্পের কাছাকাছি হরিনাথপুরে। হরিনাথপুর একটি ছোট কলোনি বিশেষ ।দেশভাগের পর বহু ছিন্নমূল মানুষ সেখানে পাকাপাকি তাদের বসতি স্থাপন করেছিল। দিদিমা প্রায়ই বলতেন এখানে আগে ছিল শুধুই জল কচুর বন আর আঁশ শেওড়ার ঝোপ। এমনকি আমি নিজেও ওই অঞ্চলে গিয়ে বেশ কিছু পরিত্যক্ত জলা জমি দেখেছি। প্রোমোটারের নেক নজরে পড়লে সেখানে হয়তো ফ্ল্যাটবাড়ি উঠতে পারত। এমনিতে হরিনাথপুর জায়গাটা আমার ভীষণ প্রিয়। আমরা কলকাতার মানুষ। গ্রামবাংলায় আসি একটু টাটকা বাতাসের খোঁজে, আর হরিনাথপুরে সেসব অফুরন্ত। এমন একটি চমৎকার জায়গায় এসে এত ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হবে যদি আগে জানতাম তাহলে সে...