সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

স্বজন- তুষারকান্তি রায়

 


জোরে হাওয়া বইছে। ঘরে ঢুকে পড়ছে কালবৈশাখীর বাতাস। বৃষ্টিও শুরু হলো। কলি বুঝলো  মা গরম গরম চপ আর কফি নিয়ে ঘরে ঢুকছেন। তবু জানালা দিয়ে বাইরের দূরের মাঠের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। বেশ লাগছে। দীর্ঘ লকডাউনের পর লকডাউন পার করে আনলক পর্যায় এর কয়েক ধাপ শেষ। অতিমারির প্রকোপ কমছে কই।  সেই থেকেই তো একটানা নিজের বাড়িতে। অনলাইনে কাজ।আর নিজের ঘরে। কতোদিন এভাবে থাকা হয়নি বাড়িতে - ঘরে।

কলিদের বাড়িতে ঢোকার মুখে রাস্তায় একটা পলাশ গাছ আছে। লাইটপোষ্টের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে গাছটাকে। ক'দিন আগেও আগুন রঙের ফুলে ছেয়ে গিয়েছিলো।  আর এখন কেমন আপাদমস্তক ভিজে দাঁড়িয়ে  আছে। মাথাটা দুলছে মাঝে মাঝে।

মা ডাকলেন,  ' আয়, কফি ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।' 

কলি সাড়া দিলো না। বাইরে বড় বড় বৃষ্টির দানা কালো রাস্তার উপর পড়ে কেমন বুদবুদ তৈরি করে ছড়িয়ে পড়ছে। কলি চোখ বন্ধ করে ভেজামাটির সোঁদা গন্ধ শ্বাস ভরে বুকে চালান করে দিতে থাকে।

-  কি রে আয়।  খাবি তো! 

কলি ঘুরে তাকায়। সারাদিন পর একটু আগেই ফিরেছে মেয়েটা। ফ্রেশ হয়ে হলুদ কাফতানে  ভারি উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। এখন দেখে  কে বলবে ক'দিন ধরে এই মেয়েটাই জিনস্ -  শার্ট - বুট পরে মাঝে মধ‍্যই হাই স্পিডে বাইক চালিয়ে টিম স্বজনের হয়ে সারা পরুলিয়ায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে!  গ্লাভস - মাস্ক - হেলমেট এ তনুকাও তখন নিজের মেয়েকে চিনতে পারে না।

এদিকে  এলোমেলো হাওয়ায় জানালার পর্দা  উড়িয়ে বৃষ্টির ছাট ঢুকে পড়ছে ঘরে।

- জানালাটা বন্ধ করে দিই?  

কলি চেয়ারে বসতে বসতে বলে,  'থাক না মা। ভালো লাগছে। তুমি ও এসো। ' 

   তনুকাও এসে বসলেন। '  আজ খুব ধকল গেছে না রে?  '

- তা একটু গেছে মা। আজ কোটশিলার খৈরী প্রাথমিক স্কুলে আশ্রয় নেওয়া নতুন আসা  বারোজন পরিযায়ী শ্রমিককে খাইয়ে দাইয়ে আই টি আই এর কোয়ারিন্টিন সেন্টারে পাঠানো হয়েছে। 

  তনুকা কফিতে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির চোখে তাকালেন। বিপদে মানুষের পাশে থাকতে পেরে মেয়েটা নিজের কথা ভুলে গেছে।

- জানো তো মা!  টিম স্বজনের অতনু ,  স্হিতা,  কনিষ্ক  সহ সকলেই  খুব ভালো। নিজেরা প্রতিষ্ঠিত হয়েও মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে।  ওদের সঙ্গে কাজ করতে বেশ লাগছে। 

-  জানিস তো কলি আজ অতনুর বাবা এসেছিলেন।

কফি শেষ করে কাপটা টেবিলে রাখে। মায়ের ভীত মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়,  '  তাই না কি?  হঠাৎ  উনি এলেন যে?  ' 

 - কথায় কথায়  উনি অতনুর সঙ্গে তোর বিয়ের প্রস্তাব দিলেন।

   এমনটিই কলি আন্দাজ করেছিলো। মাথাটা ঝাঁকিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় মায়ের দিকে। ঝাঁকুনির তোড়ে কলির খোলা চুল চোখে মুখে  এসে পড়ে। দু'হাতে চুল গোছাতে গোছাতে রাগত স্বরে বলে,  ' মা!   তুমি ও! দুনিয়ার সবাই জানে তোমার মেয়ে ডিভোর্সি।  ' 

-  তাতে কি?  ঘর তো করিস নি। তাছাড়া  অতনু তোর ছোটবেলার বন্ধু। ওর বাবা তো  সবই তো জানেন  ।

-  আমার একটা চাকরি আছে। কলকাতায় স‍্যাটলড্।  আর নতুন করে কিছু চাই না মা।  তাছাড়া  অতনু একজন আইডিয়াল ডাক্তার।   ওর  আলাদা একটা দুনিয়া আছে। আমার ও। 

   আর কথা বাড়ানোর সাহস করেননি তনুকা।

     #          #          #        #         #


রাত তখন প্রায় তিনটে হবে।  খুটখাট শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো তনুকার।  পাশের ঘরে আলো জ্বলছে। উঠে এসে দেখলেন কলি বাইরের পোশাকে রেডি।  ঘুম জড়ানো গলায় অবাক হয়ে বললেন,  ' কোথাও যাচ্ছিস কলি? '

-  অতনুদের বাড়ি। এক্ষুনি তোমাকে ডাকতাম,  মা।

-  সে কি !  কেন ?  

-  ওর বাবা ফোন করেছিলেন। হঠাৎই  অতনুর খুব জ্বর আর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। কলকাতায় নিয়ে যাচ্ছেন। আমি ও যেতে পারি।  ফোন করে সব জানাবো তোমাকে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ঝড়ের আড়ালে- দোলা সাহা

  অসহায় স্তব্ধতায় বুক দুরু দুরু; ক্ষনিক আশা যাহা ছিল মনে, ভাঙিল তা প্রবল করাঘাতে। বেদনার গ্লানি, আর শোকাতুর মন বাধিল ক্ষনিক আশা একটু স্নেহের পরশ জরাহীন ভারতবর্ষ মুক্ত করো সবে হারিয়ে যেতে দেবনা আমরা গভীর অন্ধকারে শত শত ক্ষত ভরিয়ে তুলব- গভীর মমতায় ভরা স্নেহের প্রলেপে।

অন্য পুজো - পিনাক

  ১ অনেকদিন ধরেই ছেলেটা বায়না ধরেছে এবার পূজোয় একটা নতুন জিন্সের প্যান্টের জন্য। বছরদুয়েক আগে ওর বাবা অন্ধ্রে রাজমিস্ত্রীর কাজ করতে গিয়েছিলো, তারপর থেকে আর ফেরেনি। এখনো পর্যন্ত তার কোনো খোঁজখবরও পাইনি সে।পাঁচবাড়ি দুইবেলা কাজ করে কোনোমতে সংসারটা টেনেটুনে চলে যায় আর মিডডে মিলের দয়ায় ছেলের একবেলা পেটটা কোনোরকমে ভরে যায় রোজ। অনেক ইতস্তত করে আজ বড়বাড়ির বৌ এর কাছে পাঁচশ টাকা চেয়েই বসেছিল ফুলমনি ছেলের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। অনেকদিনের বিশ্বস্ত লোক, দু'বছরে একদিনও কামাই করেনি:বড়বাড়ির বৌ তাই টাকার কথাতে একবারের বেশী দুবার ভাবেনি।  আজ বিকেলে মনটা বেশ খুশি ছিল ফুলমনির। টুসিদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাড়ি না ফিরে সোজা চলে গিয়েছিল বড়রাস্তার ধারে কাঁচের দরজা দেওয়া জামাকাপড়ের দোকানটার দিকে। রাস্তায় গাড়ি বেশী ছিলো না তখন; দোনোমোনো করে রাস্তাটা পেরোতে গিয়েছিল সে। বকুলতলার দিক থেকে বিকট শব্দ করে হঠাৎ একটা গাড়ি চলে আসে দানবের মতো! তারপর... মায়ের ডাকে ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে যায় পল্লবের! ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে সে বিছানায়... ২ ৩৪ নং জাতীয় সড়ক ধরে শ্যমলকে বাইক চালিয়ে রোজই ফিরতে হয় অফিস থেকে। আজ অফিস থেকে বেড়িয়ে অফিসের ...

পচন- মনোজ কুমার সরকার

  আজ যে কাহিনীর অবতারণা করতে চলেছি পাঠকের কাছে তা নিছক একটি গল্প হলেও আসলে আমার জীবনেই এই বিচিত্র ঘটনাটি ঘটেছিল। অন্তত সেদিন একবিংশ শতাব্দীর যুক্তিবাদী শিক্ষিত মানুষ হওয়া সত্বেও আমি এই ঘটনার জটিল রহস্যের কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি। সেই বিচিত্র ঘটনার দর্শকের ভূমিকা নেওয়া ছাড়া সেদিন আমার আর কিছুই করার ছিল না। বছর দশেক আগের কথা। সেবার গ্রীষ্মের ছুটিতে গেলাম মামার বাড়ি বেড়াতে ।মা, বাবা, ভাই ও আমি অর্থাৎ সপরিবারে ।আমার মামাবাড়ী রানাঘাটে কাপাস ক্যাম্পের কাছাকাছি হরিনাথপুরে। হরিনাথপুর একটি ছোট কলোনি বিশেষ ।দেশভাগের পর বহু ছিন্নমূল মানুষ সেখানে পাকাপাকি তাদের বসতি স্থাপন করেছিল। দিদিমা প্রায়ই বলতেন এখানে আগে ছিল শুধুই জল কচুর বন আর আঁশ শেওড়ার ঝোপ। এমনকি আমি নিজেও ওই অঞ্চলে গিয়ে বেশ কিছু পরিত্যক্ত জলা জমি দেখেছি। প্রোমোটারের নেক নজরে পড়লে সেখানে হয়তো ফ্ল্যাটবাড়ি উঠতে পারত। এমনিতে হরিনাথপুর জায়গাটা আমার ভীষণ প্রিয়। আমরা কলকাতার মানুষ। গ্রামবাংলায় আসি একটু টাটকা বাতাসের খোঁজে, আর হরিনাথপুরে সেসব অফুরন্ত। এমন একটি চমৎকার জায়গায় এসে এত ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হবে যদি আগে জানতাম তাহলে সে...