ছোটো থেকেই ভোর ভোর উঠে পড়া অভ্যেস দ্বৈপায়নের। কলেজ লাইফে মেসে থাকাকালীন একটু দেরি হতো উঠতে, তবে তারপর আবার পুরোনো এই অভ্যাসটা ফিরে এসেছে ওর।
উজানী এখনও ঘুমোচ্ছে,কাল রাতে জ্বরটা বাড়াবাড়ি রকমের হয়েছিল।দ্বৈপায়নও ঘুমোয়নি রাতে।
সারা রাত উজানীর মাথায় জলপট্টি দিয়ে গেছে,আর থার্মোমিটার দিয়ে দেখে গেছে,পারদ নামলো কিনা!চারটে নাগাদ একটু শুয়ে আবার ছটায় উঠে ফ্রেশ হয়ে দুকাপ কফি নিয়ে এল ওদের শোয়ার ঘরে।
কফির কাপ দুটো বিছানার পাশের ছোট্ট টেবিলটার ওপর রাখলো,তারপর চোখ গেল উজানীর স্নিগ্ধ মুখটার ওপর।যেন একটা বাচ্চা মেয়ে খুব নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে, নিরাপদ আশ্রয়ে।
উজানীর ঘুমটা ভাঙলো দ্বৈপায়নের হাতের স্পর্শে। কপালে আলতো করে হাত দিয়েছে ও। আস্তে আস্তে চোখ খোলে উজানী।স্মিত হেসে তাকালো দ্বৈপায়নের দিকে। দ্বৈপায়নের মুখটা দেখলে যেন জাগতিক সব শান্তি খুঁজে পায় উজানী। উজানী আর দ্বৈপায়নের বিয়ে হয়েছে মাত্র চার মাস। এরমধ্যেই উজানী ওর বাবার ছায়ামুর্তি দেখতে পায় দ্বৈপায়নের মধ্যে।ওর হাতের ছোঁয়ায়,মুখের ছোট্ট হাসিতে যেন এক অনন্য আনন্দ খুঁজে পায়।
চোখ খুলতেই দ্বৈপায়ন জিঞ্জেস করল,"এখন কেমন লাগছে ম্যাডাম?"
উজানী একটু উঠে বসলো, তারপর বললো,"শরীর ভালো না হয়ে যাবে কোথায়! এমন একটা মানুষ পাশে থাকলে ওই অসুখ বাবাজি থাকতেই পারে না বেশিক্ষণ, কিন্তু কাল তোমার একদম ঘুম হয়নি, আজ তো রবিবার, একটু রেস্ট নাও, আমি এবার উঠি।"
উজানী উঠতে যেতেই চোখের ইশারায় দ্বৈপায়ন বুঝিয়ে দিল,এখন চুপটি করে বসো।
তারপর ওর হাতে কফির কাপটা তুলে দিয়ে নিজে আরেকটা কাপ তুলে চুমুক দিল কফিতে।
উজানী কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দ্বৈপায়নের দিকে, তারপর দ্বৈপায়নের নাকটা আলতো করে ধরে বলে ,"এই যে দীপ বাবু, আপনার মেমসাব এখন পুরোপুরি সুস্থ,মা'রা চলে আসবে,সরো রান্নাবান্না গুলো করতে হবে তো!
আর এবার তুমি একটু রেস্ট নাও, নাহলে আমি কিন্তু খুব বকবো।"
বলেই কফিটা খেয়ে বিছানা ছাড়ল উজানী।
দ্বৈপায়ন কিছু একটা বলতে গেলে,ও বললো চুপচাপ রেস্ট নাও, ফ্রেশ হয়ে চটপট স্যান্ড্রুইচ করে আনছি।আর তারপরেও অনেক কাজ, বাবা-মা দের লাগেজ গোছাতে হবে,পরশুই তো ওঁদের ফ্লাইট!
দ্বৈপায়নের পুরো পরিবার গেছে ওর পিসতুতো বোনের বিয়েতে। উজানীর দুদিন ধরেই শরীরটা খারাপ,তাই খুব ইচ্ছা থাকলেও যাওয়া হয়নি ওর। দ্বৈপায়নের মা যেতে চাইনি, বলেছিল মেয়েটার এমন শরীর খারাপ, ওকে রেখে কোথাও যাব না, তখন উজানীই অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে শাশুড়িকে পাঠায় অনুষ্ঠান বাড়ি।
আজ তাদের ফেরার কথা অনুষ্ঠান বাড়ি থেকে।
আবার পরশুই তাদের ফ্লাইট দিল্লির, ওদের মূলত হরিদ্বার যাওয়ার কথা। কিন্তু দ্বৈপায়ন আর উজানী ছাড়া পুরো পরিবার যাবে হরিদ্বার,আর ওরা দুজন যাবে শিলং তাদের প্রথম হানিমুনে।
প্রায় মাসখানেক আগে উজানীর বাবার একটা মাইনর অপারেশন হয়েছিল, তখন ও কিছুদিন ওর বাপের বাড়িতেই ছিল।
সেরকমই একটা দিনে খেতে বসে দ্বৈপায়নের মা বলেছিল, বিয়ের পরে উজানীকে নিয়ে কোথাও তো যাওয়া হয়নি তোর এখনো, এবার একটু ঘুরে আয়।ওর বাবা একটু সুস্থ হলেই যেখান থেকে হোক দুজনে একটু সময় কাটিয়ে আয়।
দ্বৈপায়ন সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল, বেশ তো তবে আমি কালকেই সবার জন্য টিকিট কেটে আনছি,সবাই মিলে খুব মজা হবে,বলো কোথায় যাবে মা? দ্বৈপায়নের মা বলেছিল, না,সবাই নয়, শুধু তোরা দুজনে ঘুরে আসবি, আর দরকার হলে আমরা আর তোর কাকারা হরিদ্বারটা ঘুরে আসবো।
বোঝার চেষ্টা কর,তোর প্রতিদিন অফিস,ওর স্কুল,তার ওপর আমাদের যৌথ পরিবার, মেয়েটা তোকে তো একা পায়ইনা কখনো,ওরো তো ইচ্ছে করে তার স্বামীর সাথে একান্তে কিছুটা সময় কাটাতে!
যাক আর কোনো তর্ক করবি না, যেটা বললাম সেটা করবি, লক্ষ্মী ছেলে আমার!
এরপর আর কোনো কথা বলে লাভ নেই,জানে দ্বৈপায়ন।
সুতরাং ও পরের দিন আটটা টিকিট কাটলো ফ্লাইটের।
ছটা দিল্লির,আর দুটো গৌহাটির।
অনুষ্ঠান বাড়ি থেকে ফিরে এসেছে সবাই। দুপুরে খাওয়ার সময় ছোট্টু সবাইকে পরিবেশন করছে।
উজানী খাবার দিতে গেলে ছোট্টু ভাঙা ভাঙা বাংলায়ই বলে,তুমার শরীর খারাপ দিদি,তুমি বুসো আমি দিচ্ছি সুবাইকে।
উজানী ওকে বলে কিচ্ছু হবে না, ঠিক আছি আমি, তবে ছোট্টু কিছুতেই ওর কথা থেকে নড়েনি।তাই অগত্যা ছোট্টুর হাতেই আজ পরিবেশনের দায়িত্ব।
ছোট্টু ছেলেটা বড্ডো ভালো, খুব মিশুকে। দ্বৈপায়ন যখন আলিপুরদুয়ার ব্রাঞ্চে ছিল তখন ওখানেই কাজ করতো ছোট্টু।ওর যখন বদলি হয়, তখন কেঁদে ফেলেছিল ছোট্টু।
বলেছিল,বাবুসাব মাত যাও,আপ একই তো হো মেরা আপনা,অউর তো মেরা কোয়ি নেহি হে।
দ্বৈপায়নেরও খুব খারাপ লেগেছিল বাচ্চা ছেলেটার জন্য, তিন বছর ধরে ও সাথে ছিল দ্বৈপায়নের।
দ্বৈপায়ন সিদ্ধান্ত নেয় ওকেও নিয়ে আসবে ওর শান্তিপুরের বাড়িতে।এক কথায় রাজি হয়ে গেছিল ছোট্টু।
কিন্তু এখন ও ওর বাবুসাবের থেকে তার দিদিমনিকেই বেশি ভালোবাসে,সে নিয়ে যখন মজা করে অভিযোগ করেছে দ্বৈপায়ন, তখন ছোট্টুও বলে দিয়েছে,বাবুসাব আপ তো মেরে সবকুছ হো,লেকিন দিদি তো মা লকচমি হে,তো উস্কে খেয়াল রাখনা মেরা ফার্স বানতা হে।
যাক,আজ নিজে হাতে ইলিশ মাছের ঝাল রান্না করেছে উজানী,আর ওর এই ইলিশ মাছ রান্না বা খাওয়া দেখলেই দ্বৈপায়ন নিজের হাসি সামলাতে পারে না। কারণ বিয়ের আগে মোহনবাগান সাপোর্টার হওয়ার দরুন সে ইলিশ মাছ ছুতো পর্যন্ত না।
উপরন্তু ইলিশ মাছ দেখলে নাকি ওর পায়ের পাতা থেকে মাথার চুল পর্যন্ত জ্বলে যেতো।
স্বভাবতই আজও হাসি আটকাতে না পারায় বকুনিও খেতে হয়েছে ওকে সকলের কাছ থেকে, উজানী তখন হেসে গেছে শুধু।
এখন দ্বৈপায়নের খুব অবাক লাগে। পুরোনো দিন গুলোর কথা মনে পড়তে থাকে শুধু।
একটা সময় ছিল যখন উজানীর সামনে গেলে হাত পা কাঁপতো ওর,গলা শুকিয়ে যেত, কথা আটকে যেত। কিছুতেই চোখের দিকে তাকাতে পারতো না ও।
আসলে দ্বৈপায়ন সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছিল উজানীর ব্যক্তিত্বকে। আর সেই ভালোবাসা আজ স্বার্থক।
আজও ভেবে হাসি পায়,ওদেরই এক কমন ফ্রেন্ডের বিয়েতে দ্বৈপায়ন প্রপোজ করে উজানীকে।তাও আবার এক নিঃশ্বাসে,চোখ বন্ধ করে। তখনো হাত পা কেঁপেছিল দ্বৈপায়নের।
আর আজ সেই উজানী কতোটা কাছের, সংসারে সবার চোখের মণি।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে উজানী বলে,আজ একটু বাবা মায়ের সাথে দেখা করে আসি। দ্বৈপায়ন অন্য দিন হলে কিছুই বলতো না, তবে সেইদিন বললো,আজ শরীরটা তোমার খারাপ, বাবা মায়েরা নাহয় পরশু যাচ্ছে, আমাদের ফ্লাইট তো তারও দুদিন পর,পরে গেলেও তো হবে।
উজানী শুধু বলেছিল, একটু দরকার আছে। দ্বৈপায়ন আর এই নিয়ে কথা বাড়ায়নি,জিঞ্জাসা করেছিল, আমি যাব? তখন উজানী বলে, আমি আমার আদরের ননদ কে নিয়ে যাবো। সত্যি আরাধ্যাটাও হয়েছে এক্কেবারে বৌদিমণি অন্তর প্রান।
পরের দিনটা গোছগাছ করতে করতেই সময় কেটে যায়।
সকলেই ব্যস্ত।
দ্বৈপায়ন এখন ছুটি নিয়েছিল কিছুদিন,তাই ঔ হাতে হাতে সাহায্য করতে থাকে প্যাকিংয়ে।
এরপর সকলে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে ওরা।পরের দিন দুপুর বারোটায় ফ্লাইট।
উজানী আর দ্বৈপায়নও যাবে বাকি সবাইকে ছাড়তে এয়ারপোর্ট। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়তে হবে। একঘন্টা আগে রিপোর্টিং।
সকালে উঠেই গোছগাছ করে গাড়িতে উঠে পড়ে সবাই।
আড্ডা ইয়ার্কি করতে করতে যখন এয়ারপোর্ট পৌঁছায় তখন ঘড়িতে দশটা।
হাতে অনেক সময়।
লাগেজ গুলো ছোট্টু আর ড্রাইভার নামাচ্ছিল, দ্বৈপায়নও হাত লাগলো।
হঠাৎ ওর ব্যাগটা দেখে অবাক হয়ে গেল, জিঞ্জাসা করল,একি আমার ব্যাগ এখানে কেন?
সকলে একটু অবাক, শুধু মাত্র উজানী ছাড়া।
সে নির্লিপ্ত মুখে বললো,তা আপনি ফ্লাইট ধরবেন,বেড়াতে যাবেন, আপনার লাগেজ যাবে না, সেটা কি কখনো হয়!!
দ্বৈপায়ন যেন আকাশ থেকে পড়ে, বলে,"মানে?"!!
সকলের চক্ষু চড়কগাছ তখন।
উজানী গড়গড় করে বলে যায়, মানেটা কিছুই না!
তুমি টিকিট গুলো মায়ের কাছে দিয়েছিলে,আর আমি বাপের বাড়ি থেকে ফেরার পর মা সেগুলো আমাকে তুলে রাখতে বলে। এখন কাজ ছিল দুটো,এক গৌহাটির টিকিট ও হোটেল বুকিং ক্যানসেল আর দুই দিল্লির ফ্লাইটের এক্সট্রা দুটো টিকিট কাটা।ব্যাস হয়ে গেল।
এবার আরো একটা সারপ্রাইজ আছে, দিল্লিতে তোমার মাসিমাকে ফোন করেছিলাম, দাদাভাই ছুটি নিয়েছে,দ্যে উইল অলসো জয়েন আস।
একসাথে সবাই মিলে হুল্লোড় হবে।
সকলে চুপ, একদৃষ্টে সবাই তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে।
উজানী আবার বলে,মা তুমি যদি ভেবে থাকো দ্বৈপায়ন শুধু আমার সেটা খুব ভুল, তোমাদের ছাড়া ওউ যে বড্ডো অপূর্ণ। ওকে ভালোবেসেছি বলে কি শুধু ওকেই ভালোবাসি!!তোমরা কি আমার কেও নউ?
শোনো ছোটো থেকে একা একা মানুষ, একসাথে থাকার আনন্দ জানতাম না, কিন্তু এই আনন্দ যখন একবার পেয়েছি, সেটা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখি কি করে!!
ছোটো থেকে তোমার দীপকে তুমি বাবা খুব আদর করেছো, এবার সেই আদরের ভাগিদার আমি,সেই আদর থেকে এক মূহুর্তের জন্যও বঞ্চিত হতে চায় না আমি।
এই বলে যখন চুপ করলো ও, তখন ওর চোখে জল।
দ্বৈপায়নের মা বুকে জড়িয়ে নেয় ওকে।ওই অবস্থাতেই উজানী বলে, তোমার ছেলে ভেবেছে বার বার হারিয়ে দেবে আমায়, মোহনবাগানকে বার বার হারানো সোজা নয়।।
সকলের মুখে হালকা হাসি, চোখের কোণে জল। আর হয়তো এই রকম চোখের জল গুলোর জন্যই বেঁচে আছি আমি, তুমি,আমরা সবাই।
এমন সময় আরাধ্যা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো,
"জয় মোহনবাগান"।
দ্বৈপায়ন রাগি ভঙ্গিতে বললো আচ্ছা এখন সবাই দেখছি বৌমনির দলে!
তারপর আরাধ্যাকে কাছে ডেকে বললো, তোর বৌদি মনিকে বলে দিস, এভাবে যদি হেরে যেতে হয়, তবে এই ইষ্ট বেঙ্গল বার বার হারতে রাজি ওই মোহনবাগানের কাছে।
সকলের মুখে হাসি, আনন্দে ভর করে আবার আকাশ ছোঁবে ওরা।
তবে ছোট্টুর এটাই প্রথম বিমান সফর।ওর জন্য সবথেকে বেশি আনন্দ হচ্ছে আমার,আর আপনাদের??!!.....!!

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন